‘কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা’, ওসিকে সাংসদ শাহীন চাকলাদার

‘আপনি রাতেই থানায় বোমা মারেন। তারপর সাইফুলের নামে মামলা করেন। এরপর বলেন, পুলিশকে সিভিল কাপড়ে পাঠিয়ে ইটভাটায় বোমা মেরে ডাকাতির উদ্দেশ্যে হামলা-এমন একটা মামলা দেন। মামলা করতেই হবে- এটাই শেষ কথা।’ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির ( বেলা) কর্মী যশোর কেশবপুর উপজেলার বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহ সম্প্রতি ওই উপজেলার সাতবাড়িয়া এলাকার ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং আদালত থেকে ভাটার বিরুদ্ধে নির্দেশনাও আনেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দীনকে মোবাইল ফোনে এমন নির্দেশ দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দীনকে ফোন করে থানায় বোমা মেরে ‘ডাকাতি’ চেষ্টার অভিযোগ এনে সাইফুল্লাহকে মামলার আসামি করতে বলেন এমপি শাহীন চাকলাদার। আর থানায় বোমা মেরে পরিবেশ আন্দোলন কর্মীকে ফাঁসানোর নির্দেশ দেন এমপি। এরপর ওই অডিও ফাঁস হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ওই অডিও রেকর্ডটি।
শাহীন চাকলাদার নিজে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে অডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার সন্ধ্যায় কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেখেন এমপি সাহেবের সঙ্গে অনেক বিষয়েই আমার বহুবার কথা হয়। কখন কোন কথা হয়েছে, বিশেষ করে অডিও রেকর্ডের কথোপকথনের বিষয়টি আমার স্মরণে নেই।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শনিবার এমপি শাহীন চাকলাদারকে একাধিক বার ফোন করেও তার ফোনটি ব্যস্ত পাওয়া যায়। এরপর তিনি ফোন ধরেননি এমনকি তিনিও ফোন করেননি। তবে তিনি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, অডিও রেকর্ডটি টেম্পারিং করা হয়েছে। ওসির সঙ্গে এ সংক্রান্ত কোনো কথা হয়নি। জনপ্রিয় এমপিকে (শাহীন) বিতর্কিত করার জন্য একটি পক্ষ মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে।

এদিকে, এরই মধ্যে ওই অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এমপি এবং ওসির কথোপকথনের অডিও ফাঁসে তোলপাড় চলছে। এমপি শাহীন চাকলাদার ও ওসি মো. জসিম উদ্দিনের কথোপকথন:
ওসি: আসসালামু আলাইকুম স্যার।

শাহীন চাকলাদার: সাতবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ কিডা, চেনো?

ওসি: সাতবাড়িয়া, সাইফুল্লাহ আছে, স্যার ওই ইটভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, ‘বেলা’য় যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোনো জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠাণ্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। সে (সাইফুল্লাহ) বারবার যেয়ে কেন করে, আপনি কী করেন?

ওসি: ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।

শাহীন চাকলাদার: আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট- ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?

ওসি: হাইকোর্টে স্যার…

শাহীন চাকলাদার: ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাঘারপাড়ার ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ও ওসি… চেনেন? বাঘারপাড়া ওসিকে চেনেন?

ওসি: চিনি না আবার স্যার? মামুন সাহেবরে?

শাহীন চাকলাদার: কথা বইলেন তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যে কোনোভাবে, যে কোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে?

ওসি: স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ও কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?

শাহীন চাকলাদার: ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?

ওসি: স্যার, স্যার। দেখবোনে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: কেমন অফিসার আপনি, আল্লাই জানে। কাজ দিলি কাজ পারেন না।

ওসি: হা হা হা হা স্যার। সব কাজই তো করি, স্যার।

শাহীন চাকলাদার: সব কাজ করেন, না? তালিপরে যে কোনো ভাটায় যেয়ে, দরকার হলি পুলিশের লোক দিয়ে সিভিলে বোম ফাটায় দিয়ে চলে আসুক। বলতে হবি যে, হামলা করেছে ডাকাতি করার জন্য। এটা ছিল অমুক। একটা বানাই দিলে অয়া গেল।

উল্লেখ্য, যশোর-৬ ( কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর ২০২০ সালের ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন হয়। ওই উপনির্বাচনে বিজয়ী হন যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। শাহীন চাকলাদার সদর উপজেলা পরিষদের তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলেন।

নিরাপত্তা চেয়ে পরিবেশকর্মী সাইফুল্লাহর জিডি

ফোনালাপ ফাঁসের পর নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী শেখ সাইফুল্লাহ। শনিবার (৩০ জানুয়ারি) কেশবপুর থানায় এই জিডি করেন সাইফুল্লাহ। এতে তিনি নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে, নিরাপত্তা দিতে সংশ্লিষ্ট থানায় আবেদন করেন।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়, ‘একটি অনলাইন সংবাদপত্রের মাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি সংসদ সদস্য শাহিন চাকলাদার কেশবপুর থানার ওসিকে মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য মোবাইল ফোনে চাপ প্রয়োগ করেছেন। কেশবপুর থানার সাতবাড়ীয়া গ্রামে অবস্থিত সুপার ব্রিক্স নামক একটি ইটভাটা রয়েছে। যার লাইসেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র না থাকায় এবং পরিবেশ দূষণ করায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়। পরে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) কাছে আইনি সহায়তা চায়। এরপর তাদের সহায়তায় হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মূলক মামলা দায়ের করেন।’

সুত্র:  কালের কন্ঠ